হোম আমাদের সম্পর্কে জেলা বিচার বিভাগের ইতিহাস
কালের বিবর্তনে কুমিল্লা বিচারবিভাগ
মেঘনা, গোমতী, তিতাস-তীরের ঐতিহাসিক জনপদ কুমিল্লা যা ঐতিহাসিকভাবে ত্রিপুরা নামে পরিচিত ছিলো। শালবন বিহার, ময়নামতির ইতিহাসবিধৌত ও জনপদের যেমন রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, তেমনি এর আইন ও বিচার অঙ্গনেরও রয়েছে ধ্রুপদি ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে কুমিল্লা বিচার বিভাগ এতদ্ঞ্চলের মানুষের শত শত বছর ধরে ন্যায় বিচার প্রদানের মহতী প্রতিষ্ঠানরূপে দায়িত্ব পালন করে আসছে।
বিট্রিশ শাসনের শুরুর দিকে যখন মুঘল শাসনের কার্যকারিতা কমে যায় তখন বিট্রিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৭২ সালে অন্যান্য জেলার মতো তদানীন্তন ত্রিপুরা জেলায় একটি ফৌজদারী আদালত প্রতিষ্ঠা করে যেখানে একজন কাজী, একজন মুফতী ও ০২ জন মৌলভী নিয়োগ করা হয়। এর পাশাপাশি একটি দেওয়ানী আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে প্রাথমিকভাবে কালেক্টর বিচার করতেন। ১৭৭৪ সালেই সেটি পরিবর্তন করে দেওয়ানী আদালতের কার্যভার দেওয়া হয় স্থানীয় আমিন পদমর্যাদার বিচারকদের কাছে, ফৌজদারী আদালতের বিচারের ভার দেওয়া হয় থানাভিত্তিক ফৌজদারের উপর। ১৭৯৩ সালে তৃতীয় ও নবম রেগুলেশনের মাধ্যমে যথাক্রমে একজন দেওয়ানী জজ নিয়োগ করে তাকে ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতা দেওয়া হয়। কোম্পানীর শাসনের প্রথম থেকেই ত্রিপুরা জেলার বিচার ও প্রশাসনিক কার্য একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ১৮৩১ সালে দেওয়ানী মামলার বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা জজদের উপর ন্যস্ত করা হয়। ১৮৫৯ সালে এসে ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টরের পদকে একত্র করা হয়।
১৮৭৭ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরা জেলা জজ নোয়াখালী জেলা জজ হিসেবে কাজ করেন। বিভিন্ন সময়ে ত্রিপুরা জেলার অধীনে বর্তমান কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলা যুক্ত ছিলো। ১৮৮৫ সালেই মূলত কুমিল্লা জেলা জজের বর্তমান পদটি সৃষ্টি হয় এবং তখন থেকেই তিনি জেলার ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিচার বিভাগের এককভবে সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯১০ সালের ত্রিপুরা গেজেটিয়ার থেকে দেখা যায় সেসময় ত্রিপুরা জেলার একজন জেলা জজ, ০৩ জন সাব জজ ও ১২ জন মুন্সেফ ছিলেন। জেলার সকল বিচারক এবং জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটসহ জেলার সকল প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটদের আপীল শুনতেন বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ।
ঐতিহ্য
কুমিল্লার বিচার বিভাগ ও কুমিল্লা বার এসোসিয়েশনে ব্রিটিশ আমল থেকেই আইনগজতের নানা দিকপালের পদচারণা রয়েছে। কুমিল্লা বিচার বিভাগ থেকে যেমন অনেক বিচারক কলকাতা হাইকোর্ট ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হয়েছেন, তেমন কুমিল্লার আইনজীবীদের অনেকেই দেশের প্রথিতযশা আইনজ্ঞ, আইনসভা ও গণপরিষদের সদস্য, মন্ত্রীসহ নানা পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী রায় বাহাদুর মোহনী মোহন বর্ধন, কলিকাতা হাই কোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারপতি স্যার সৈয়দ সামছুল হুদা, ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার ডেপুটি স্পিকার অখিল চন্দ্র এডভোকেট, পাকিস্তানের প্রথম কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী কামিনী কুমার এডভোকেট, বাংলাদেশের আইন মন্ত্রী এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কুমিল্লার জেলায় দায়িত্ব পালন করে স্বাধীন বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিচারপতি মোহাম্মদ হামিদুল হক, বিচারপতি শিকদার মকবুল হক, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেন, বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি আতাবুল্লাহ্ প্রমুখ।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কুমিল্লার আইন ও বিচার অঙ্গনের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। বৃটিশ ভারতে ফারসি যখন অফিস আদালতের সওয়াল জবাবের ভাষা, তদানীন্তন ত্রিপুরা আদালতে মাতৃভাষা বাংলায় বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য জেলা জজ বাহাদুর থেকে অনুমতি আদায় করে নেন এডভোকেট মোহনী মোহন বর্ধন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যে সাহসী পদক্ষেপ, সেটিও গ্রহণ করেছিরেন কুমিল্লা বারের কৃতি আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এছাড়াও কুমিল্লার আইন অঙ্গনে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম এডভোকেট-এর মতো মানুষও রয়েছেন যারা পেয়েছেন ভাষা সৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় খ্যাতি।
গৃহীত উদ্ভাবনী কার্যাবলী
কুমিল্লা বিচার বিভাগের চারটি বহুতল দালানে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এ জেলায় বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন বিজ্ঞ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ জনাব হেলাল উদ্দিন। জনাব মোঃ হেলাল উদ্দিন বিগত ২০২২ সনের ১৪ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলায় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি এর পূর্বে ময়মনসিংহ জেলার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে কর্মরত থাকাকালীন ময়মনসিংহ জেলা বিচার বিভাগ ‘প্রধান বিচারপতি পদক, ২০২২’ লাভ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি কুমিল্লা জেলায় যোগদানের পর হতেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুরাতন মামলা দ্রত নিষ্পত্তি, সমপর্যায়ের আদালতে মামলার সম বণ্টনসহ অফিসারদের নিয়মিত তদারকি করছেন। তিনি প্রতি মাসে সকল বিচারকদের নিয়ে নিষ্পত্তি সংক্রান্ত সভা করে সর্বোচ্চ নিষ্পত্তিকারী বিচারককে অনুপ্রেরণা ও অন্যান্য বিচারকগনকে নানাবিধ দিক-নির্দেশনা প্রদান করছেন। তাছাড়া তিনি অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ, সিনিয়র সহকারী জজ, সহকারী জজ ও ম্যাজিষ্ট্রেটগণকে নিয়ে পৃথকভাবে প্রতি মাসে বসে আপীল ও রিভিশন শুনানীকালে প্রাপ্ত ত্রুটিবিচ্যুতিসমূহ নিয়ে আলোচনা করেন যার ফলে অফিসারদের ভুল থেকে শেখার সুযোগ তৈরী হয়েছে। তিনি প্রচলিত নিয়মে নিষ্পত্তির পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সকল বিজ্ঞ বিচারকগণকে উৎসাহিত ও নিয়মিত তদারকি করেন। তাছাড়া তিনি পুরাতন দেওয়ানী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দেওয়ানী মামলা পরিচালনাকারী বিজ্ঞ আইনজীবীগণের সাথে আলোচনা করে তাদের অনুপ্রাণিত করেন যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে অত্র জজশীপে মামলা নিষ্পত্তির হার শতভাগের বেশী। মামলা নিষ্পত্তি, আদালত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আদালতে আগত বিচার প্রার্থী জনগণের সুবিধার্থে পাবলিক টয়লেট সংস্কার, আদালতে আগত বিচার প্রার্থীদের বসার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ৩০ মার্চ, ২০২৩ পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অত্র জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল ও শিশু আদালতের মামলা ব্যতীত ৭৬,৩০০ টি মামলা বিচারাধীন আছে যার বিপরীতে বিচারক, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালগন ব্যতীত মাত্র ৩৭ জন বিচারক কর্মরত আছেন যা অপ্রতুল। তথাপি এই জেলায় কর্মরত বিচারকগণ দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে কর্ম নিষ্ঠার সাথে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
সংকলকঃ
জনাব মোঃ ইমাম হাসান, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ও
জনাব মুহাম্মদ ওমর ফারুক, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট